জুলাই আন্দোলনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ‘খুলনা গেজেট’

আয়শা আক্তার জ্যোতি

জুলাই আন্দোলনের সময় খুলনা গেজেট ছিল অনলাইন নিউজ পোর্টাল । বর্তমানে দৈনিক পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ করেছে। ঝকঝকে তকতকে চার পৃষ্ঠার রঙিন কাগজ প্রতিদিন সকালে পৌঁছে দিচ্ছে পাঠকের কাছে। জুলাই আন্দোলনের সময় এই নিউজ পোর্টালের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপে পোর্টালটি সত্য ও নিরপেক্ষ সংবাদ প্রকাশ করে জনগণের কাছে তুলে ধরেছে।

এই অনলাইনটি জনগণের দাবি-দাওয়া, আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে আন্দোলনকে গতিশীল করতে ভূমিকা পালন করে। অনলাইনটি শুধু সংবাদ পরিবেশনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং মুক্তচিন্তা ও জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে আন্দোলনের শক্তিকে আরও সাহসী করেছিল। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকায়। সেই আন্দোলনের এসে পৌঁছায় খুলনার রাজপথেও। নগরীর রাজপথেও সেই আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে।

আন্দোলনের মঞ্চে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সাধারণ নাগরিক, শিক্ষক, সংগঠক ও নানা শ্রেণির মানুষ একত্রিত হন। নগরীর প্রতিটি মোড়ে, প্রতিটি শ্লোগানে ফুটে উঠেছি তার চিত্র।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান সহিংসতা ও সংঘাতের কারণে সারাদেশের মত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলোজি, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, খুলনা আলিয়া কামিল মাদ্রাসা, সরকারি ব্রজলাল কলেজ, সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজ, আযম খান সরকারি কমার্স কলেজ, সরকারি সুন্দরবন কলেজ ও জিলা স্কুলসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন ২৬ জুলাই নিয়ে আসে টানটান উত্তেজনা। সকাল থেকে জিরোপয়েন্ট, শিববাড়ি মোড়সহ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা সমবেত হয়। এসময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘কোটা নয়, মেধা চাই’, ‘চাকরি পেতে, স্বচ্ছ নিয়োগ চাই’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘এই বাংলায় হবে না, বৈষম্যের ঠিকানা’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’ এসব স্লোগান শহরজুড়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

কিন্তু দুপুরের পর পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিয়ারগ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে। সংঘর্ষে পুলিশের কনস্টেবল সুমন ঘরামি নিহত হন : আহত হন বহু শিক্ষার্থী। ভীতিপ্রদ অভিযান ও গ্রেপ্তার চললেও রাজপথের প্রতিরোধ থেমে থাকেনি। শিক্ষার্থীদের একক আন্দোলন দ্রুতই পরিণত হয় সামাজিক প্রতিরোধে। স্থানীয় নাগরিক সমাজ, শিক্ষক, সেনাসহ স্থানীয় সংগঠন আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা মানববন্ধন, শোভাযাত্রা ও স্মরণসভা আয়োজন করে আহত ও নিহতদের প্রতি সহমর্মিতা জানান। একদিকে দমন-পীড়ন, অন্যদিকে মানুষের সহানুভূতি-দুইয়ের দ্বন্দ্বেই শহর তখন যেন প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।

খুলনা গেজেট অনলাইনটি ঘটনাগুলোকে শুধু খবর হিসেবে নয়, ইতিহাসের অংশ হিসেবেও লিপিবদ্ধ করেছে। আমাদের গণমাধ্যমটি দায়িত্ব সাথে প্রতিটি সংঘর্ষ, প্রতিটি স্লোগান এবং প্রতিটি মানববন্ধনের ভেতরে যে বার্তা লুকিয়ে ছিল তা তুলে ধরেছিল জনসাধারণের কাছে। স্থানীয় বাস্তবতা ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতা পাঠকের সামনে অনলাইনের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিল। যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্ম জানতে পারে জুলাই আন্দোলনে এই শহর কেবল দর্শক ছিল না, বরং সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

১ এই সময় আমাদের প্রকাশিত প্রতিবেদন গুলোর সাধারণ মানুষের মধ্যে সাড়া জাগায়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য-

২ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : চাকরিতে কোটা বাতিল : নতুন করে তিন দিনের কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের।

৪ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : হাইকোর্টের রায় স্থগিত না হওয়ায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা, ক্ষুব্ধ শাহবাগ, কোটা বাতিলের দাবিতে খুবি শিক্ষার্থীদের জিরোপয়েন্টে সড়ক অবরোধ।

৫ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : দ্বিতীয় দিনের মতো খুবি শিক্ষার্থীদের জিরোপয়েন্টে সড়ক অবরোধ।

৬ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : নগরীতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, শিববাড়িতে সড়ক অবরোধ।

৭ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : কোটা বাতিলের দাবিতে কুয়েটের শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি।

১১ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : পুলিশের বাঁধা উপেক্ষা করে বৃষ্টির মধ্যে খুবি শিক্ষার্থীদের জিরোপয়েন্ট অবরোধ।

১৬ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে খুবি শিক্ষকদের সংহতি প্রকাশ।

১৭ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : দেশের সব স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ঘোষণা, ঢাবির সব হল শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে।

৩১ জুলাই প্রকাশিত প্রতিবেদন : শিক্ষার্থী-পুলিশ সংঘর্ষে রণক্ষেত্র খুলনা, লাঠিচার্জ-টিয়ালশেলে আহত ৬০, আটক শতাধিক।

১ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন : শিক্ষার্থী-পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় দুই মামলা, কারাগারে ১১, রাবিতে শিক্ষার্থীদের তুলে নেওয়ার চেষ্টা, বাধা হয়ে দাঁড়ান শিক্ষকরা-ধস্তাধস্তি।

২ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন : রোববার থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ডাক, শনিবার বিক্ষোভ, খুলনায় ছাত্র-পুুলিশ সংঘর্ষে আহতের অনেকের শরীরে গুলি, খুলনায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ : পুলিশের গাড়িতে আগুন, গুলিবিদ্ধ অনেকে, গল্লামারী মোড়ে ফের পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধ ৬, খুলনায় গণমিছিলে পুলিশের টিয়ারসেল, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ।

৩ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন : দেশের ৫ জেলায় গণমিছিলে সংঘর্ষ, নিহত ২, শিক্ষার্থীসহ জনসাধারণ হত্যা ও বিচারের দাবিতে নগরীতে শিক্ষকদের মানববন্ধন-মৌন মিছিল, ৯ দফা দাবিতে সাতক্ষীরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রিকশাচালকদেরও একাত্মতা, যশোরে এক দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিশাল বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও পুলিশ হত্যা : খুলনায় পুলিশের ৩ মামলা, আসামি ৮৫০০।

৪ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন : আজ থেকে শিক্ষার্থীদের অসহযোগ শুরু, মাঠে থাকবে আ.লীগ, খুলনায় শিববাড়ি চত্বরে শিক্ষার্থীরা, ৭টি পয়েন্টে মাঠে থাকবে আ’লীগ, খুলনা শিববাড়িতে আন্দোলনকারীদের অবস্থান, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার পর খুলনা আ’লীগ কার্যালয়ে আগুন, খুলনায় আ’লীগ কার্যালয় ও সংসদ সদস্যের বাড়িতে আগুন, বাবুল রানা ও সুজন আইসিইউতে, অসহযোগের মধ্যে দুদিনের নতুন কর্মসূচি আন্দোলনকারীদের, অভয়নগরে ছাত্র-জনতার অবস্থান, হাইওয়ে থানা ভাঙচুর, কঠোর অবস্থানে পুলিশ, বাগেরহাটে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, পুলিশ ও সাংবাদিকসহ আহত ১৫, খালিশপুরে বিএনপির দুই কার্যালয় ও বকুলের বাড়িতে আগুন এবং

৫ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদন : খুলনায় ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাস, খুলনার সড়কে হাজারো মানুষের বিজয় উল্লাস, মিষ্টি বিতরণ, রাজধানী জুড়ে লাখো জনতার উচ্ছ্বাস, ছবিতে খুলনায় ছাত্র-জনতার বিজয় উল্লাস।

গণঅভ্যুত্থানের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে-ময়দানে কাজ করে গেছে এই গণমাধ্যমের সাহসী সাংবাদিকরা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিফ রিপোর্টার মোঃ মিলন। ওই সময় তিনি বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ অবরোধে স্ব-শরীরে উপস্থিত থেকে চিত্রধারণ ও নিউজ সংগ্রহ করে অল্প সময়ে সাধারণ মানুষের সামনে শহরের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মিছিলে ছাত্র ও পুলিশের মাঝখানে পড়েও তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন। একইভাবে অগ্রজ হাসান হিমালয় আমাদের সাহস জুগিয়েছেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করেছিলেন অর্ক মণ্ডল। খুবির যেকোনো মিছিল-সমাবেশ শুরু হলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত হতেন এবং পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা আসার সাথে সাথেই তা সংবাদ আকারে প্রকাশ করতেন। তার এই দ্রুততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে খবরকে মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

একইভাবে এস. এম. সাদি’র অবদানও অনস্বীকার্য। বিক্ষোভ মিছিল ও সংঘর্ষের মুহূর্তগুলো স্থিরচিত্র ও ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে ধারণ করে গণমাধ্যমে প্রচার করেছেন। তার ক্যামেরার চোখে ধরা আন্দোলনের প্রতিটি দৃশ্য সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলস্বরূপ, খুলনার আন্দোলনের সংবাদ দেশের অন্য শহরের গণমাধ্যমের তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়।

সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তখনকার সময়ে শুধু খুলনা নয়, সমগ্র দেশের পাঠক-দর্শকের কাছে আন্দোলনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছিল। সর্বোপরি এই অনলাইনটির কর্মীরা তখন নিজেদের কথা চিন্তা না করে নগরীর পরিস্থিতি দেশ ও বিশ্বের সামনে প্রতিবেদনের মাধ্যমে উপস্থাপন করে গেছে। আমাদের প্রতিবেদন গুলো দেশে ও বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। যা সব সাধারণ মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগায়।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন